গ্রামের নাম ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া। গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডে এর অবস্থান। ঈদুল আজহায় গ্রামের সবাই মিলে পশু কোরবানি দেন এখানে। এরপর দুপুর থেকে গ্রামে চলে মাংস ভাগাভাগির কাজ।
জানা গেছে, এই গ্রামে প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলছে এ সামাজিক কোরবানির মাংস তৈরি ও বিতরণের কাজ। স্থানীয় ধনী-গরিব সবাই এ মাংসের অংশীদার। কোরবানি দেয়া পশুর মাংস ভাগ তৈরি করে বিকেলের মধ্যে বণ্টন শেষ করা হয়।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, এটি গ্রামের পুরোনো একটি প্রথা। এখানে একদল স্বেচ্ছাসেবক স্বেচ্ছায় পুরো কাজটি পরিচালনা করেন। শুরুতে তালিকা তৈরি করা হয় ও সে তালিকা অনুযায়ী, ঈদের আগের দিন প্রত্যেকের বাড়িতে ঘরে ঘরে টোকেন পৌঁছে দেয়া হয়। পরে ঈদের দিন দুপুর থেকে গ্রামের মানুষ কোরবানির মাংস নিতে ঈদগাহ মাঠে আসতে থাকেন। পরে স্বেচ্ছাসেবকরা মাংস বণ্টন শুরু করেন। আর টোকেন জমা রেখে বিকেলের মধ্যে এ কাজ শেষ করা হয়।
তবে যেহেতু এটি কোরবানির ঈদ তাই গ্রামের বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের জন্যও রাখা হয় বরাদ্দ। অনেক পুরোনো এ প্রথাটি এ গ্রামের দেখাদেখি এখন অনেকেই পালন করছেন বলেও জানান অয়োজকরা।
ওই গ্রামের কলেজ শিক্ষার্থী ইমন মিয়া জানান, আমরা স্বেচ্ছায় সাত বন্ধু মিলে সামাজিক এ মাংস বণ্টনের কাজ করছি। তৈরি করা শেষে এলাকার মুরুব্বি ও বড় ভাইদের সহযোগিতায় গ্রামের সবার মাঝে মাংস বণ্টন করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কাজটি করতে এসে এদিন এলাকার সবাই একত্রিত হন। এ সময় সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে খুব ভালো লাগে। এক সময় আমাদের বড় ভাইরা এ দায়িত্ব পালন করতেন, এখন সে দায়িত্ব আমাদের হাতে। একদিন হয়তো একই দায়িত্ব আমাদের ছোট ভাইরা পালন করবে।
গ্রামের বাসিন্দা হেলাল উদ্দিন সরকার জানান, ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া গ্রামে যারা পশু কোরবানি দেন, তারা কোরবানি দেয়া প্রতিটি পশুর মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ জমা দেন এ সামাজিক ভাগ-বণ্টনে। গ্রামের প্রত্যেকের বাড়ির জন্য একজন করে ভাগীদার ধরে মাংস ভাগ করা হয়। এবার প্রায় ৩০০ ভাগ করা হয়েছে মাংস। এ সময় স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকিং করে মুসলিমদের ডেকে এনে মাংস বণ্টন করা হয়।
ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি রফিজ উদ্দিন জানান, বাংলাদেশে অনেক গ্রাম রয়েছে, যেখানে কোরবানি হয় মসজিদ কমিটির মাধ্যমে। কোরবানির মাংস যেন সমাজের সবার ঘরে পৌঁছায়, সেজন্য মাংসের তিন ভাগের একভাগ মসজিদ চত্বরে জমা করতে বলা হয়। জমা করা মাংস মসজিদের আওতাভুক্ত প্রতিটি পরিবারে মাঝে ভাগ করা হয়। ধনী-গরিব সবাই সমান হারে ভাগ পান। এই নিয়মে মাংস বিতরণের ফলে কোরবানির দিন কেউ মাংস পাওয়া থেকে বাদ পড়েন না।
তিনি আরো জানান, এক সময় আমাদের বাপ-চাচারা এ দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের হাত ধরে আমরা করেছি। এখন সামাজিক এ মাংস বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে আমাদেরই ভাই-ভাতিজারা। এইভাবে প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো এ রীতি আমরা টিকিয়ে রেখেছি। এটি এখন একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আরাফুজ্জামান বলেন, এ রীতিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। তবে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবাগুলো ভাগ হয়ে ছোট হয়ে যাওয়ায় সামাজিক কোরবানির এ প্রথা দিন দিন কমে আসছে। সেক্ষেত্রে ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা এখনও এ প্রথাটিকে টিকিয়ে রেখেছেন, যা প্রশংসার দাবিদার।
ভাদার্ত্তী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মো. ছাফায়েত উল্ল্যাহ জানান, কোরআন হাদিসের আলোকে সামাজিক এ রীতিটি সত্যি অন্যরকম। এখানে ধনী-গরিব সবার মাঝে সমানভাবে মাংস বণ্টন করা হয়। এছাড়া প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্যও রাখা হয় আলাদা বরাদ্দ। এ প্রথাটি এক প্রজন্মের হাত ধরে অন্য প্রজন্মেও টিকে থাকুক এটিই এখন প্রত্যাশা।